আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিসের মতে, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন খেলাপি ঋণ নবায়নের সুবিধা ব্যাংক খাতে ‘ক্রেডিট নেগেটিভ’ বা ঋণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই নীতির কারণে অবকাঠামো শুষ্ক পরিস্থিতি সাময়িকভাবে কমলেও, দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে এবং ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। সোমবার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে এই বিষয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন খেলাপি ঋণ নীতিমালা ঘোষণা করে, যেখানে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ নিয়মিত করতে ২ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে। এই ঋণের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর থাকবে। ঋণ নিয়মিত হলে, শুরুতে দুই বছরের বিরতিসহ ঋণ পরিশোধের সুযোগ পাবেন ঋণগ্রহীতারা।
মুডিস মনে করে, এই দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ড থাকলে ঋণগ্রহীতাদের প্রকৃত পরিশোধক্ষমতা যাচাইয়ে বিলম্ব হবে, যার ফলে খেলাপি ঋণের প্রকৃত হার কৃত্রিমভাবে কম মনে হতে পারে। এছাড়া, সম্পদমানের ঝুঁকিও আড়াল করতে পারে। তারা আরও জানায়, পুনঃতফসিলের পর ৯০ দিনের মধ্যে মামলা প্রত্যাহার করা আবশ্যক, যা অবিলম্বে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, এবং যদি ঋণ kembali খেলাপি হয়, তবে ক্ষতির ঝুঁকি বাড়বে।
মুডিসের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালের জুলাই মাসে ঋণ নিয়মকানুন শিথিল হওয়ার ফলে ব্যাংক খাতে ঋণ পুনঃতফসিলের প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল, কিন্তু সেই সময় ঋণ পুনরুদ্ধার হয়নি। তারা সতর্ক করে দেয়, এই শিথিল নীতির কারণে ঋণ পুনরুদ্ধার কঠিন হয়ে উঠতে পারে, ও ঋণ পুনঃতফসিলের যথাযথ মনিটরিং না থাকলে, দুর্বল ঋণ কাগজে-কলমে সচল দেখা যেতে পারে, যা আসল ঝুঁকি থেকে মুক্তি দেবে না।
বলা হয়, ২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ ব্যাংক খাতের অনাদায়ী ঋণের হার ছিল মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১.১ শতাংশ। তবে ২০২৫ সালের মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪.১ শতাংশ। একই সময়ে ব্যাংকগুলোর মূলধন-ঝুঁকি অনুপাত নেমে এসেছে ৩.১ শতাংশে, যা দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত মানের থেকে অনেক নিচে। নিস্পত্তি বা অনাদায়ী ঋণের বিপরীতে সংরক্ষণের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশে।
মুডিস উল্লেখ করে, তারা যে তিনটি ব্যাংকের ঋণ মান নির্ধারণ করেছে, সেগুলোর পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। ব্যাংক তিনটি হলো ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক।
তাদের মতে, ঋণগ্রহীতাদের চাপ কমানোর জন্য ও খেলাপি ঋণ কমানোর লক্ষ্যে ন্যূনতম সুদের হার থেকে কম সুদে ঋণ দেওয়া হবে, যাতে ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা বাড়ে এবং খেলাপি ঋণের ক্ষতি কমে। এই উদ্যোগ উভয় পক্ষের জন্যই উপকারী। তবে, মাত্র ২ শতাংশ অগ্রিম পরিশোধের সীমা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংক ও গ্রাহকদের সম্পর্কের ভিত্তিতে বিদ্যমান খেলাপি ঋণের জন্য কমপক্ষে ২ শতাংশ নগদ অর্থ জমা দিতে হবে। এই অর্থ জমা দিয়ে ঋণ নিয়মিত হলে, দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ (ঋণ পরিশোধে বিরতি) ঋণের মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। যদি আগে কোনো ঋণ তিন বা তার বেশি বার পুনঃতফসিল হয়, তবে অতিরিক্ত ১ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে।
এছাড়াও, যদি ঋণদাতা নির্ধারিত সময়ে তিন মাস বা এক ত্রৈমাসিক কিস্তি দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি হিসেবে মনে করা হবে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, আগে যা অর্থ জমা দেওয়া হয়েছিল, তা ২ শতাংশ হিসেবে গণ্য হবে না। নতুন করে জমা দেওয়া অর্থ সম্পন্ন হলে, ছয় মাসের মধ্যে সেই আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছে, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনঃতফসিল করার উপায় দেখিয়ে দিতে। পাশাপাশি, এই সুবিধা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংক ও গ্রাহকদের মধ্যে মৌখিক কার্যক্রম স্থগিত করতে হবে যেন চলমান মামলা সম্পর্কিত কার্যক্রম বন্ধ রাখা যায়।
উত্তরাধিকার, চলতি বছরের জুন শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৭.০৯ শতাংশ। গত এক বছরে এই ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।