১০:৫৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ২০ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষঃ
নির্বাচনই গণতন্ত্রের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি: প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের যৌথ উদ্যোগ চায় রাজনৈতিক দলগুলো সংশোধিত মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশে টিআইবির গভীর উদ্বেগ ভোটার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১২ কোটি ৭৬ লাখ জাতীয় নির্বাচন শেষে ফেব্রুয়ারিতেই বইমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নবীনগরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হামলা-গুলিবর্ষণে নিহত ১, আহত ৩ নোয়াখালীতে গ্রাম আদালত বিষয়ক দ্বিতীয় ব্যাচের প্রশিক্ষণ শুরু জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের পরে তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে সরকার আশাবাদী সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে, ইসি আনোয়ারের দাবি সমাজ-রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে বিএনপির কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয়: রুহুল কবির রিজভী

জয়পুরহাটে হিমাগারে ৩৪ লাখ বস্তা আলু, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি

জয়পুরহাট হলো দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলু উৎপাদনকারী জেলা, যেখানে আন্তর্জাতিক মানের আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ হয়। এই জেলার আলুর গুণগত মান ভালো হওয়ায় বিদেশে রপ্তানি হয়, তবে এই বছর প্রকৃতিপরিস্থিতি ও বাজারের অস্থিরতার কারণে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। বিভিন্ন হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর অবস্থা এখন দুঃস্বপ্নের মতো।

জেলায় বর্তমানে ২১টি হিমাগারে মোট ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ বস্তা আলু সংরক্ষিত রয়েছে। প্রতি বস্তায় গড় মূল্যের হিসাবে যদি ৮৫০ টাকা লোকসান ধরা হয়, তবে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২০ কোটি টাকা। তবে এই ক্ষতি আরও বৃহৎ, কারণ পূর্বে এই হিমাগার গেট থেকে ২০ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৬ বস্তা আলু বিক্রি হয়েছিল, যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। এভাবে, আলু সংরক্ষণ ও বিক্রির মাধ্যমে মোট ক্ষতির অংক প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

স্থানীয় কৃষকরা জানাচ্ছেন, সরকারিভাবে আলু কেনার কোনও উদ্যোগ না থাকায় তারা মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়ে গিয়েছেন। বাজারে আলুর দাম না বাড়া ও ক্রেতা সংকটের কারণে হিমাগারে জমে থাকা আলু বিক্রি করতে পারছেন না কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। ফলে তারা ইতিমধ্যে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানাচ্ছে, গত মৌসুমে জেলার ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১০ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছিল। এর মধ্যে ২ লাখ ৬ হাজার ৭১৬ টন বা ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ২৬৬ বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ ছিল। বর্তমানে সেই আলুর মধ্যে ৮২ হাজার ৮৩৯ মেট্রিক টন বা ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ বস্তা এখনও হিমাগারে পড়ে রয়েছে।

সড়ক পথে বিভিন্ন হিমাগার ঘুরে দেখা যায়, নভেম্বর-ডিসেম্বরে নতুন মৌসুমের আলুর রোপণের সময় আসছে, কিন্তু পুরনো আলু সংগ্রহস্থলে থাকায় সংকট চলছে। হিমাগারগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অনেক আলু তুলতে পারছে না চাষিরা কারণ বর্তমান বাজারদরে প্রতিটি বস্তায় অন্তত ১০৫০-১০৭০ টাকা লোকসান হচ্ছে। তাই কেউই আলু তোলার সাহস পাচ্ছেন না।

সদর উপজেলার সোটাহার ধারকী গ্রামের কৃষক ফেরদৌস মোল্লা বলেন, সার ও সেচের সিন্ডিকেটের কারণে তারা প্রয়োজনীয় সার পাচ্ছেন না। এখন আবার উচিৎ দাম না পেয়ে পড়েছেন ক্ষতির মুখে। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তারা বেতন বাড়ে, ট্যাক্সও বৃদ্ধি পায়, কিন্তু কৃষকদের অবস্থা দুর্বিষহ। কৃষকরা আন্দোলন করতে পারেন না, কারণ তারা গরিব ও অসহায়।

কালাই উপজেলার সুড়াইল গ্রামের আলু ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম আকন্দ বলেন, তারা আশা করেছিলেন ভালো দামে আলু বিক্রি করবেন। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায়, বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ৫ লাখ ২০ হাজার টাকায়, যেখানে তিনি দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, প্রায় ৫১ লাখ টাকার হার। এই ক্ষতিটা তার সব সঞ্চয় ভেঙে দিয়েছে।

প্রতিটি হিমাগারেই একই চিত্র। কালাই পৌর শহরের এম ইসরাত হিমাগারে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মিলিয়ে ৫ হাজার ২৬০ জন আলু সংরক্ষণ করেছেন, যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৮ কোটি টাকা।

কালাই পৌরশহরের শিমুলতলী এলাকার আর বি স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজের মালিক প্রদীপ কুমার প্রসাদ বলেন, তাদের হিমাগারে দুই লাখ ৬০ হাজার বস্তা আলু ছিল। দেড় মাস আগে এগুলো সরানোর কথা থাকলেও এখন তা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ আলু তুললে বড় ক্ষতি হবে বলে আতঙ্কে আছে সবাই।

অন্য একজন ব্যবসায়ী, ক্ষেতলাল উপজেলার কামরুজ্জামান মিলন, বলেন, উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত এক কেজির জন্য খরচ হয়েছে ২৪-২৫ টাকা, অথচ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৯-১০ টাকায়, ফলে প্রতি কেজিতে ১৬ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।

আরেক ব্যবসায়ী মিঠু ফকির বলছেন, তিনি ১২ হাজার বস্তা আলু রেখেছিলেন, এর মধ্যে ১০ হাজার বিক্রি করে দিয়েছেন। বাকি দুই হাজার এখনো হিমাগারে রয়েছে, যেখানে প্রতিটি বস্তায় ৯০০ টাকার লোকসান হচ্ছে। এতে তার মোট ক্ষতি প্রায় ৯০ লাখ টাকা।

অভূতপূর্ব এই ক্ষতি হাজারো কৃষকের জীবনকে হুমকি দিচ্ছে। ক্ষেতলাল উপজেলার কৃষক রকিব উদ্দিন মন্ডল বলেন, তারা দীর্ঘ দিন ধরে আলু চাষ করছেন, কিন্তু এমন বিপর্যয় আগে দেখেননি। এই বছর তারা ১ হাজার ২০০ বস্তা আলু রোপন করে ১০ লাখ টাকার ক্ষতি করেছেন।

মোটের ওপর, জয়পুরহাটের হিমাগারগুলোতে পড়ে থাকা আলুর বর্তমান অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। সরকারি উদ্যোগের অভাবে, বাজারের অস্থিতিশীলতা আর চাহিদার কমে যাওয়ায় কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা বড় সঙ্কটে পড়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হয়েছিল, আলু সংগ্রহ ও বিপণনের জন্য নির্দিষ্ট দাম ঘোষণা ও কার্যকর করা হবে। তবে এখনো সে আশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি, ফলে তাদের কপালে ভাঁজ পড়েছে।

ট্যাগ :

রাশিয়ার পরমাণু পরীক্ষায় ট্রাম্পকে চাপ দিতে চায় রাশিয়া

জয়পুরহাটে হিমাগারে ৩৪ লাখ বস্তা আলু, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি

প্রকাশিতঃ ১১:৫৪:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩ নভেম্বর ২০২৫

জয়পুরহাট হলো দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলু উৎপাদনকারী জেলা, যেখানে আন্তর্জাতিক মানের আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ হয়। এই জেলার আলুর গুণগত মান ভালো হওয়ায় বিদেশে রপ্তানি হয়, তবে এই বছর প্রকৃতিপরিস্থিতি ও বাজারের অস্থিরতার কারণে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। বিভিন্ন হিমাগারে সংরক্ষিত আলুর অবস্থা এখন দুঃস্বপ্নের মতো।

জেলায় বর্তমানে ২১টি হিমাগারে মোট ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ বস্তা আলু সংরক্ষিত রয়েছে। প্রতি বস্তায় গড় মূল্যের হিসাবে যদি ৮৫০ টাকা লোকসান ধরা হয়, তবে মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২০ কোটি টাকা। তবে এই ক্ষতি আরও বৃহৎ, কারণ পূর্বে এই হিমাগার গেট থেকে ২০ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৬ বস্তা আলু বিক্রি হয়েছিল, যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। এভাবে, আলু সংরক্ষণ ও বিক্রির মাধ্যমে মোট ক্ষতির অংক প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

স্থানীয় কৃষকরা জানাচ্ছেন, সরকারিভাবে আলু কেনার কোনও উদ্যোগ না থাকায় তারা মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়ে গিয়েছেন। বাজারে আলুর দাম না বাড়া ও ক্রেতা সংকটের কারণে হিমাগারে জমে থাকা আলু বিক্রি করতে পারছেন না কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। ফলে তারা ইতিমধ্যে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানাচ্ছে, গত মৌসুমে জেলার ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে প্রায় ১০ লাখ ৬১ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছিল। এর মধ্যে ২ লাখ ৬ হাজার ৭১৬ টন বা ৩৪ লাখ ৪৫ হাজার ২৬৬ বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ ছিল। বর্তমানে সেই আলুর মধ্যে ৮২ হাজার ৮৩৯ মেট্রিক টন বা ১৩ লাখ ৮০ হাজার ৬৫০ বস্তা এখনও হিমাগারে পড়ে রয়েছে।

সড়ক পথে বিভিন্ন হিমাগার ঘুরে দেখা যায়, নভেম্বর-ডিসেম্বরে নতুন মৌসুমের আলুর রোপণের সময় আসছে, কিন্তু পুরনো আলু সংগ্রহস্থলে থাকায় সংকট চলছে। হিমাগারগুলোর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অনেক আলু তুলতে পারছে না চাষিরা কারণ বর্তমান বাজারদরে প্রতিটি বস্তায় অন্তত ১০৫০-১০৭০ টাকা লোকসান হচ্ছে। তাই কেউই আলু তোলার সাহস পাচ্ছেন না।

সদর উপজেলার সোটাহার ধারকী গ্রামের কৃষক ফেরদৌস মোল্লা বলেন, সার ও সেচের সিন্ডিকেটের কারণে তারা প্রয়োজনীয় সার পাচ্ছেন না। এখন আবার উচিৎ দাম না পেয়ে পড়েছেন ক্ষতির মুখে। অন্যদিকে সরকারি কর্মকর্তারা বেতন বাড়ে, ট্যাক্সও বৃদ্ধি পায়, কিন্তু কৃষকদের অবস্থা দুর্বিষহ। কৃষকরা আন্দোলন করতে পারেন না, কারণ তারা গরিব ও অসহায়।

কালাই উপজেলার সুড়াইল গ্রামের আলু ব্যবসায়ী আব্দুল আলিম আকন্দ বলেন, তারা আশা করেছিলেন ভালো দামে আলু বিক্রি করবেন। কিন্তু দাম পড়ে যাওয়ায়, বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ৫ লাখ ২০ হাজার টাকায়, যেখানে তিনি দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, প্রায় ৫১ লাখ টাকার হার। এই ক্ষতিটা তার সব সঞ্চয় ভেঙে দিয়েছে।

প্রতিটি হিমাগারেই একই চিত্র। কালাই পৌর শহরের এম ইসরাত হিমাগারে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মিলিয়ে ৫ হাজার ২৬০ জন আলু সংরক্ষণ করেছেন, যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৮ কোটি টাকা।

কালাই পৌরশহরের শিমুলতলী এলাকার আর বি স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজের মালিক প্রদীপ কুমার প্রসাদ বলেন, তাদের হিমাগারে দুই লাখ ৬০ হাজার বস্তা আলু ছিল। দেড় মাস আগে এগুলো সরানোর কথা থাকলেও এখন তা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ আলু তুললে বড় ক্ষতি হবে বলে আতঙ্কে আছে সবাই।

অন্য একজন ব্যবসায়ী, ক্ষেতলাল উপজেলার কামরুজ্জামান মিলন, বলেন, উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত এক কেজির জন্য খরচ হয়েছে ২৪-২৫ টাকা, অথচ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৯-১০ টাকায়, ফলে প্রতি কেজিতে ১৬ টাকা ক্ষতি হচ্ছে।

আরেক ব্যবসায়ী মিঠু ফকির বলছেন, তিনি ১২ হাজার বস্তা আলু রেখেছিলেন, এর মধ্যে ১০ হাজার বিক্রি করে দিয়েছেন। বাকি দুই হাজার এখনো হিমাগারে রয়েছে, যেখানে প্রতিটি বস্তায় ৯০০ টাকার লোকসান হচ্ছে। এতে তার মোট ক্ষতি প্রায় ৯০ লাখ টাকা।

অভূতপূর্ব এই ক্ষতি হাজারো কৃষকের জীবনকে হুমকি দিচ্ছে। ক্ষেতলাল উপজেলার কৃষক রকিব উদ্দিন মন্ডল বলেন, তারা দীর্ঘ দিন ধরে আলু চাষ করছেন, কিন্তু এমন বিপর্যয় আগে দেখেননি। এই বছর তারা ১ হাজার ২০০ বস্তা আলু রোপন করে ১০ লাখ টাকার ক্ষতি করেছেন।

মোটের ওপর, জয়পুরহাটের হিমাগারগুলোতে পড়ে থাকা আলুর বর্তমান অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। সরকারি উদ্যোগের অভাবে, বাজারের অস্থিতিশীলতা আর চাহিদার কমে যাওয়ায় কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা বড় সঙ্কটে পড়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হয়েছিল, আলু সংগ্রহ ও বিপণনের জন্য নির্দিষ্ট দাম ঘোষণা ও কার্যকর করা হবে। তবে এখনো সে আশ্বাস বাস্তবায়িত হয়নি, ফলে তাদের কপালে ভাঁজ পড়েছে।