বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি গভীর অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। ফিলিস্তিনের গাজা, লেবানন, ইরান এবং ইয়েমেনসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ইসরায়েল সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, যা পুরো এলাকাকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের কার্যক্রম এখন কার্যত আঞ্চলিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি ইসরায়েল কাতার রাজধানী দোহায় বিমান হামলা চালানোর পর থেকে আঙ্কারার কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে—প্রকৃতপক্ষে কি এবার তার পরবর্তী লক্ষ্যটি তুরস্ক হতে যাচ্ছে?
বিশ্লেষকদের মতে, গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠপ্রতিবেশী কাতারে হামলার ঘটনা বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, যারা সতর্ক করে বলছেন যে, ইসরায়েল তার পরবর্তী শিকার হিসেবে তুরস্ককে লক্ষ্য করতে পারে। আমেরিকার এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ গবেষক মাইকেল রুবিন বলেছেন, তুরস্ক হতে পারে পরবর্তী বিপদসংকেত, আর এই ঝুঁকি থেকে দেশটিকে রক্ষা করতে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তির প্রভাবও খুব কম।
বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা আরও জোরদার করে তুলেছেন, ইসরায়েলের কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ‘আজ কাতার, কাল তুরস্ক’ বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করছেন। অপরপক্ষে, তুরস্কের একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা কঠোর সতর্কতা প্রকাশ করে বলেছেন, যদি ইসরায়েল তুরস্কের ওপর আঘাতের চিন্তা করে, তবে এর তীব্র প্রতিশোধ নিশ্চিত, যা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
এছাড়া, ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো গত কয়েক মাস ধরে তুরস্ককে ‘সর্বোচ্চ বিপজ্জনক শত্রু’ হিসেবে চিহ্নित করছে। বিশেষ করে, পূর্ব ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে তুরস্কের সক্রিয় উপস্থিতি ও সিরিয়া পুনর্গঠনে তার ভূমিকা ইসরায়েলকে নতুন হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতেই, গত আগস্টে আঙ্কারা ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত করে কঠোর জবাব দিয়েছে, যা শুধু অর্থনৈতিক নয়, আরও বড় রাজনৈতিক বার্তা।
অপর দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নীরবতা ও ন্যাটো সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠেছে। কাতারে বিমান হামলার পর যখন সবকিছু উত্তপ্ত, তখন ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে কোনো সরাসরি প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। আল জাজিরাকে একটি বিশ্লেষক জানিয়েছেন, তুরস্ক বুঝতে পেরেছে যে, কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটো পর্যাপ্ত নয় তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান আক্রমণ সীমা ছাড়িয়া যাচ্ছে, এর পেছনে ওয়াশিংটনের নীরব সমর্থন রয়েছে বলে ধারণা করছে বিশ্লেষকরা।
সম্প্রতি, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতা্নিয়াহুর ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণার বিষয়েও বিভিন্ন মন্তব্য উঠেছে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে এটির পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেন, যা আঙ্কারার জন্য এক ধরনের সংকেত। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাকান ফিদানও এই বিষয়কে গভীরভাবে মোকাবিলা করে বলেন, ‘এ অঞ্চলের দেশগুলোর ওপর ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ই দুষ্ট ও বিভ্রান্তিকর।’
এছাড়া, গাজা, সিরিয়া ও ইয়ে়মেনে ইসরায়েলের সামরিক উপস্থিতি বাড়তে থাকায়, পুরো অঞ্চলে সামরিক কার্যক্রম বেড়ে গেছে। সিরিয়ায় একাধিক হামলা, ইয়েমেনে বিমান অভিযান ও তিউনিসিয়ার উপকূলে সহায়তা বহনকারী জাহাজে আক্রমণের ঘটনা দেখা যাচ্ছে। ইরানসহ অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গেও ইসরায়েলের সংঘর্ষ সম্পর্কে সতর্কবার্তা জোরদার হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য আন্তঃরাজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, যা অচিরেই বৃহত্তর মিডলইস্টের রাজনীতিতেও পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সিরিয়া ও লেবাননে ইসরায়েল যেন নিজের প্রভাব বিস্তার করছে, যেখানে সিরিয়ায় হামলা ও হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে আঘাত ইসরায়েলের পরিকল্পনায় রয়েছে।
তুরস্কের সাবেক নৌ-অ্যাডমিরাল ও ‘ব্লু হোমল্যান্ড’ কৌশলের শীর্ষস্থানীয় নির্মাতা সেম গুরদেনিজ মনে করেন, সম্ভাব্য প্রথম সরাসরি সংঘর্ষের জায়গা হতে পারে সিরিয়ার আকাশ ও ভূমি, যেখানে মার্কিন সমর্থিত গ্রিস, গ্রিক সাইপ্রাস ও ইসরায়েলের যোগাযোগ কেন্দ্রগুলো তুরস্কের বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করছে।
সব মিলিয়ে, এর বড় চিত্র হচ্ছে—তুরস্ক ও ইসরায়েলের সম্পর্ক অনরূপভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে। ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণা, কাতারে হামলা, সিরিয়ায় প্রভাব বিস্তার এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রতিযোগিতা—এগুলো প্রত্যেকটি আঙ্কারার চোখে এখন আর শুধু প্রভাবশালী প্রতিবেশী নয়, বরং আঞ্চলিক আধিপত্যের জন্য এক শক্তিশালী উদ্দেশ্য। এর ফলস্বরূপ, তুরস্ক এবার নিজস্ব সামরিক ও কৌশলগত প্রস্তুতি জোরদার করছে, সম্ভাব্য সংঘাতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখছে। ফলে, এই দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের পথচলা কেমন হবে—এমন একটি বড় প্রশ্ন এখন মধ্যপ্রাচ্য ও সিকিউরিটি বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।