গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার ছোট গ্রামের মোবাইল মেকানিক জি এম রনি কয়েক বছর ধরে পথের বেওয়ারিশ কুকুরের জন্য এনেছেন নতুন জীবন ও সম্ভাবনা। কুকুরের প্রতি তাঁর মনোভাব কেবল সাধারণ ভালোবাসা নয়, এটি এক মানবীয় উদारতা ও দরদনা প্রকাশ। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে, তিনি বস্তা ভরা খাবার নিয়ে আসেন এবং নিজ হাতে প্রস্তুত করেন দুধ মাখানো ভাত, রুটি, বিস্কুট, আর যখন বাড়িতে মাংস রান্না হয়, তখন সেই মাছের রান্নার কিছু অংশও তিনি কুকুরগুলোর জন্য নিয়ে আসেন। মূলত, এই অভাবগ্রস্ত পোষ্যপ্রাণীদের জন্য তাঁর এই নিরলস যে caring দেখানো, সেটি স্থানীয়দের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।
প্রায় ৫ বছর ধরে, মূলত করোনাকালীন সময় থেকে এমন মানবিক কাজ শুরু করেন রনি, যা আজ এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। প্রথমে পাঁচ থেকে সাতটি কুকুরের জন্য খাবার দিয়েছিলেন, ধীরে ধীরে সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ থেকে ৩০ টিরও বেশি কুকুর। কখনো যদি কোনও কুকুর অসুস্থ হয়, বা আঘাত পায়, তখন তিনি নিজ হাতে ওষুধ দেন, ক্ষত পরিষ্কার করেন এবং যত্নের পাশাপাশি প্রেমের আঁচড় দেন।
কর্মজীবনে তিনি স্থানীয় বাজারে প্রায় ৭ বছর ধরে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন। ছোটবেল থেকেই পশুপাখির প্রতি তাঁর গভীর প্রীতি থাকায়, তিনি এগুলোকে সদা ভালোবাসা দিয়ে দেখভাল করে আসছেন। করোনাকালীন লকডাউনের কঠিন সময়ে, যখন বাজারের অনেক দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখনও তিনি কঠিন পরিস্থিতিতেও পক্ষান্তরে পথের বিড়াল বান্ধবদের খাবার দিয়েছেন। তখন থেকে অব্যাহত থাকে এই মানবিক উদ্যোগ।
প্রতিদিনের সূচিতে বস্তা ভরা ভাত, দুধ, রুটি, বিস্কুটের পাশাপাশি কখনো হাসাপাতাল ডাক্তারি সেবা ওষুধ দিয়ে কুকুরগুলোর যখন অসুস্থতা দেখা দেয়, তখন তিনি নিজে চিকিৎসা দেবেন। এই কর্মকাণ্ডে তার পরিবারের সদস্যরা, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সবাই পাশে রয়েছেন। স্ত্রী, মা-বাবা, বন্ধুরাও প্রতিদিন এই কাজে তার সহযোগিতা করেন।
রনি বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই পশুপাখির গুণাগুণ ভালোবাসি। এই ভালোবাসা থেকেই, করোনাকালীন সময়ে যখন বাজারে খাদ্য সংকট দেখা দেয়, তখন আমি এই কাজ শুরু করি। আমার এই প্রেম ও কাজ এখন পরিচিত, এমনকি আমি কোথাও গেলে ওরা আমাকে মানে, আমাকে চিনে। তবে, এখন প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে কতদিন চালিয়ে যেতে পারবো। কারণ সংখ্যাটি দ্রুত বাড়ছে, এবং এর পরিচালনাও চিন্তার বিষয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা, যেমন উজ্জ্বল সাহা, তাঁর এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, প্রথমে হয়তো সবাই তাকে উপহাস করেছিল, কিন্তু এখন সবাই বুঝতে পারছে, সে যা করছে সেটি এক অসাধারণ মানবিক কাজ। অন্যদিকে, চায়ের দোকানদার আক্কেল আলী জানান, রনি ভাই প্রতিদিন বাড়ি থেকে ভাত এনে আমাদের দোকানে দুধ কিনে তা দিয়ে কুকুর খাওয়ান। কখনো ব্যস্ত থাকলে রুটি আর বিস্কুটও দিয়ে থাকেন।
এছাড়াও, স্থানীয় ইলেকট্রোনিক্স ব্যবসায়ী সংকর সাহা বলেন, ‘প্রতিদিনই আমরা জানি উপজেলা কোথাও না কোথাও কুকুরের কামড়ের খবর আসে। কিন্তু রনির কাছের এই কুকুরগুলো এতটাই শান্ত এবং সুখী, যে কোথাও কোনও কুকুর কাঁদে বা ক্ষত হয় না। তার ভালোবাসাই এই শান্তির কারণ।’
কোটালীপাড়া কল্যাণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মাসুম মৃধা বলেন, ‘রনির এই মানবিক উদ্যোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ কেবল মানুষের জন্য নয়—অন্য জীবের জন্যও। যদি সবাই এইভাবে প্রানীপ্রেম করে, তাহলে পৃথিবীর রূপ আরও সুন্দর হতো। আমরা সবাই উচিত, রনির মতো যারা প্রাণীদের জন্য কাজ করে তাদের পাশে দাঁড়ানো।’ এইসব প্রশংসা ও স্বীকৃতি দেখিয়ে দেয়, এক মানবিক স্পৃহা কতটা মানুষের অন্তরে আলো জ্বেলে দিতে পারে।