আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরগরম হয়ে উঠেছে। নির্বাচন পরিচালনা, মুক্ত এবং সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামীণ ইউনিয়নগুলো পর্যন্ত নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক এবং প্রযুক্তিগত অবকাঠামো এখন সর্বশেষ পর্যায়ে। কমিশনের ভাষায়, ‘ভোটের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে, এখন শুধুই জনগণের অংশগ্রহণের অপেক্ষা।’
জানা গেছে, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচনের জন্য প্রাথমিক সূচি নির্ধারিত হয়েছে। এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নতুন ভোট কেন্দ্র নির্ধারণ, আসন সীমানার পুনর্বিন্যাস, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, এবং নির্বাচনী আইন সংশোধনের কাজ অনেকটাই সমাপ্ত।
নির্বাচন কমিশনের প্রধান মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘আমরা চাই একটি উৎসবধর্মী, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এজন্য সকল ধরনের প্রশাসনিক, প্রযুক্তিগত ও আইনগত প্রস্তুতি সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করছি।’
তিনি আরও জানিয়েছেন, ভোটার তালিকা ও কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার আপডেটের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। নতুন ভোটাররা যুক্ত হয়েছে প্রায় ২৫ লাখ, যাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫২ শতাংশ। বর্তমানে দেশের মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৬৩ লাখ ৭ হাজার ৫০৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৪১ লাখ ৪৫৫ জন, নারী ভোটার ৬ কোটি ২২ লাখ ৫ হাজার ৮১৯ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ২৩০। দেশের মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ৭৬১টি, যেখানে ভোটকক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪৯। পুরুষ ও নারীর জন্য আলাদা ভোটকক্ষ রয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ১৫ হাজার ১৩৭ ও ১ লাখ ২৯ হাজার ৬০২।
সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, ‘প্রতিনিধি নির্বাচন প্রস্তুতি প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ সম্পন্ন। পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সম্পন্ন হলে পুরো প্রস্তুতি চূড়ান্ত হবে।’ তিনি আরও জানান, আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যাতে প্রতিটি দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে আচরণবিধি সংশোধন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) হালনাগাদ, প্রশিক্ষণ, এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তুতিও প্রায় সম্পন্ন।
নির্বাচনী আইন সংশোধনের মাধ্যমে এবার ‘না ভোট’ পুনর্বহাল, ইভিএম ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা বাতিল, সম্পদ ও আয় সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা আরোপ, ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার বাধ্যতামূলক, প্রার্থীদের সম্পদ ও আয়ের তথ্য প্রকাশ, পলাতক আসামিদের মনোনয়ন বাতিল ও নির্বাচনী জামানত বাড়ানো হয়েছে—এই সব সংস্কার নির্বাচনটিকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিপূর্ণ করে তুলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোটের মাধ্যমে শুধু সংখ্যার হিসাব নয়, এতে জনগণের আস্থাও জরুরি। এ জন্যই তারা জোর দিচ্ছেন ভোটপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করার ওপর। সচিবালয় জানিয়েছেন, মাঠে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। তিন দিন আগে, ভোটের দিন এবং পরদিনসহ মোট আট দিন নিরাপত্তার জন্য দেড় লাখ পুলিশ, এক লাখ সেনা ও ৫৫০০০ আনসার-ভিডিপি সদস্য মোতায়েন থাকবেন। প্রচলিত আচরণবিধি মেনে এ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
প্রথমবারের মতো ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য ‘মিসইনফরমেশন মনিটরিং সেল’ গঠন করা হয়েছে। এই প্রস্তুতির মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ও অনলাইন বিভ্রান্তি নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। এছাড়াও বিদেশে থাকা প্রবাসী ভোটারদের জন্য মোবাইল অ্যাপ ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ চালু হয়েছে, যা মাধ্যমে তারা দেশের বাইরে থেকেও ভোট দিতে পারবেন। দক্ষতা অনুযায়ী ১১টি দেশে ইতোমধ্যে নিবন্ধন শুরু হয়েছে, সামনের বছর আরও কিছু দেশে এই সুবিধা বাড়ানো হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহিতুল হক বলেন, ‘নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও প্রশাসনের দৃঢ়তা জনগণের আস্থা ফেরাতে প্রথম পদক্ষেপ। যদি নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, তাহলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব।’
প্রযুক্তিগত দিক থেকেও উন্নয়ন করছে ইসি। ভোটের ডেটাবেস ও কেন্দ্রীয় সার্ভার নিরাপদ করতে সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরেকটু জোরদার করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো ভোটের দিন রিয়েল-টাইম মনিটরিং হবে জেলা পর্যায়ের কন্ট্রোল রুম থেকে, যা সরাসরি কমিশনের কাছে রিপোর্ট হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যেই মাঠে নেমেছে। প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং নভেম্বরের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দের কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করছে কমিশন। প্রার্থীদের হলফনামা যাচাই করতে একটি বিশেষ সেল কাজ করছে, যা এনবিআর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের তথ্য সংযুক্ত করবে।
নির্বাচন শুধু প্রশাসনিক অনুষ্ঠান নয়, এটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের উৎসব—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘জনগণ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে পারেন, তবে নির্বাচনের সফলতা নিশ্চিত। চান, সবাই নিরাপদে ও আনন্দের সঙ্গে ভোট প্রদান করবেন।’
গণতান্ত্রিক চেতনা আরও দৃঢ় করতে গ্রামীণ এলাকায় প্রচার কর্মসূচি চালানো হয়েছে। রেডিও, টেলিভিশন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার, পোস্টার, ব্যানার ও শর্ট ভিডিওর মাধ্যমে ভোটারদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে নারী ও তরুণ ভোটারদের প্রতি লক্ষ্য রেখে কর্মসূচি তৈরি হয়েছে।’
স্বার্থ প্রাণ ফিরে আনতে এই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও সাধারণ জনগণ। ইসি বিশ্বাস করছে, তাদের প্রস্তুতি শতভাগ, আর দেশের জনগণের অংশগ্রহণই নির্ধারণ করবে ফলাফল। শেষমেশ, নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের ভাষায়, ‘এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের আরেকটি মাইলফলক হবে। আমরা বিশ্বাস করি, জনগণই এবার প্রকৃত বিজয়ী হবে।’
 
																			 
										 শ্রীমঙ্গল২৪ ডেস্ক
																শ্রীমঙ্গল২৪ ডেস্ক								 

























