ডিসেম্বরে দেশের দুর্যোগপ্রবণ ৩৬ জেলার প্রায় দেড় কোটির বেশি মানুষ বড় ধরনের খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে শিশুর চরম অপুষ্টির শঙ্কাও। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) ও যুক্তরাষ্ট্রসহ তিনটি সংস্থার যৌথ বিশ্লেষণে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, প্রথম চার মাসের তুলনায় বছরের শেষ আট মাসে খাদ্যসংকটে থাকা মানুষের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা প্রকাশ পেলেও, বছর শেষে সামগ্রিকভাবে গত বছরের তুলনায় এই সংখ্যা কমে এসেছে।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠানে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), ইউনিসেফ এবং ডব্লিউএফপি একসঙ্গে ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন’ (আইপিসি) প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে খাদ্যঘাটতি, অপুষ্টি এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি পাঁচটি ধাপে মূল্যায়ন করা হয়, যেগুলি হলো: ১. সর্বনিম্ন বা স্বাভাবিক, ২. চাপ, ৩. সংকট, ৪. জরুরি অবস্থা, ৫. দুর্ভিক্ষ।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, ‘আমরা আইপিসি প্রতিবেদনকে পুরোপুরি সমর্থন করছি না, তবে এটা স্বীকার করছি যে সমস্যা আছে। বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়ার মাধ্যমে আমরা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা কমাতে কাজ করছি।’ তিনি আরও জানান, মে থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্লেষণ অনুযায়ী ১৭ শতাংশ জেলায় মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে থাকতে পারে। এর জন্য মূল কারণ হিসেবে কর্মসূচির অভাব, অর্থনৈতিক মন্দা, জলবায়ু পরিবর্তন, তহবিলের অভাব, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সমস্যা এবং খাদ্যবৈচিত্র্যের অভাব দেখানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, জীবন রক্ষাকারী মানবিক সাহায্য, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি সেবা, কৃষি ও মৎস্য খাতে সহায়তা বাড়ানো এবং পরিস্থিতি সব সময় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। এছাড়াও, আইপিসি বিশ্লেষণে জানানো হয়েছে, চলতি বছর কোনও জেলায় দুর্ভিক্ষের ধাপ দেখা যায়নি, তবে কক্সবাজার ও ভাসানচরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঘরোয়া লোকজনের মধ্যে জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে প্রায় তিন লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ খাদ্য সংকটের শিকার হতে পারেন।
বিশ্লেষণে জানানো হয়েছে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে ১৬টি জেলায় এক কোটি ৫৫ লাখ মানুষ ধাপ ৩ এর খাদ্য সংকটের মধ্যে ছিল। মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩টি জেলায় মোট এক কোটিরও বেশি মানুষ এই পরিস্থিতির শিকার। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ, যেখানে প্রায় ৩০ শতাংশ জনসংখ্যা খাদ্য সংকটে পড়েছে। এই অঞ্চলগুলোতে রোহিঙ্গা শিবিরের পাশাপাশি স্থানীয় জনসংখ্যা ও খাদ্যসংকটে পড়ছে।
অপরদিকে, অপর জেলাগুলোতে কিছুটা উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে—নোয়াখালী, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সিলেট ধাপ ২-এ পৌঁছডে, যেখানে খাদ্য নিরাপত্তা আরও উন্নত। তবে বাগেরহাট ধাপে উঠে আইপিসির তালিকায় প্রবেশ করেছে। ২০২৩ সালের তুলনায় পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন ইত্যাদি দুর্যোগের কারণে অনেক জেলায় আবার নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে।
অপুষ্টির দিক থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে মোট ১৬ লাখ শিশু (৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সি) তীব্র অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। পাশাপাশি, অন্তঃসত্তা ও শিশু দুধপানে থাকা মা—প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার মা—তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছেন। রোহিঙ্গা শিবিরে এই সংখ্যা খুবই উদ্বেগজনক, যেখানে ৮১ হাজারের বেশি শিশু ও পাঁচ হাজার মা ঝুঁকিতে রয়েছেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশেষ অতিথি, মৎস্য ও প্রানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, জলবায়ু-সহনশীল ও পরিবেশবান্ধব চাষব্যবস্থা গড়ে তুলতে সমস্যা মোকাবিলার জন্য কাজ চলছে। তিনি আরও জোর দিয়েছেন, সামগ্রিক খাদ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে সবাই নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যে প্রবেশের সুযোগ পায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমিয়ে আনতে হয়।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, এই প্রতিবেদনের তথ্য অনাকাঙ্ক্ষিত ও উদ্বেগজনক যে, অপুষ্টিতে ভোগা শিশু কর্মক্ষমতা ও শিক্ষায় পিছিয়ে যাবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নতির জন্য হুমকি। সকলের সচেতনতা ও দায়িত্ব নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এফএও বাংলাদেশের উপপ্রতিনিধি ডিয়া সানৌ মনে করেন, সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা দ্বারা খাদ্য সংকট মোকাবিলা সম্ভব। তিনি ঘোষণা দেন, সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।
ডব্লিউএফপি বাংলাদেশের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর সিমোন পার্চমেন্ট বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি, সামাজিক সুরক্ষা ও সমন্বিত পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি।
অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর তালহা জামাল এবং সভাপতি ছিলেন খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের মহাপরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান।
 
																			 
										 শ্রীমঙ্গল২৪ ডেস্ক
																শ্রীমঙ্গল২৪ ডেস্ক								 

























