আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়া নতুন খেলাপি ঋণ নবায়নের সুবিধা বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ‘ক্রেডিট নেগেটিভ’ বা ঋণের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সংস্থাটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই সুবিধাগুলোর কারণে ব্যাংকগুলি সাময়িকভাবে চাপ কিছুটা কম দেখলেও দীর্ঘমেয়াদে বিষয়টি ঝুঁকি বাড়াবে। পাশাপাশি ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। সোমবার প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে এ সব কিছু তুলে ধরা হয়েছে।
১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপন জারি করে উল্লেখ করে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য তারা ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণকে নিয়মিত করার সুযোগ দিচ্ছে। এই ঋণের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ১০ বছর। ঋণ নিয়মিত হলে প্রথম দুই বছর ফলটানিয়ভাবে ঋণ পরিশোধের জন্য বিরতি সুবিধা পাওয়া যাবে।
মুডিস মনে করছে, এই দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ড থাকায় ঋণগ্রহীতারা প্রকৃত পারিশ্রমিক ক্ষমতার যাচাইয়ে দেরি করবে, যা কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণের হার কম মনে হতে পারে। ফলে সম্পদমানের ঝুঁকিও লুকানো হতে পারে। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের উদ্ধৃতি দিয়ে, পুনঃতফসিলের পর ৯০ দিনের মধ্যে মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, যা পুনরুদ্ধার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং যদি ঋণগ্রহীতারা আবার খেলাপি হয়, তাহলে ক্ষতির ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে।
মুডিসের দাবি, ২০২২ সালে নিয়মকানুন শিথিলের ফলে ব্যাংক খাতে ঋণ পুনঃতফসির প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল, তবে সেই সময় ঋণের পুনরুদ্ধার হয়নি। এই শিথিল নীতির কারণে প্রকৃত অর্থে ঋণ পুনরুদ্ধার না করে বরং অদায়ি ঋণের প্রবণতা দীর্ঘায়িত হতে পারে। সংস্থাটির মতে, যদি ঋণ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া যথাযথভাবে তদারকি না করা হয়, তাহলে দুর্বল ঋণগুলো কাগজে-কলমে সচল দেখানো হলেও বাস্তবে ঝুঁকি বজায় থাকবে।
বিগত সময়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে অনাদায়ি ঋণের হার ছিল মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১.১ শতাংশ, যা ২০২৬ সালের মার্চে বেড়ে ২৪.১ শতাংশে পৌঁছায়। এর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর মূলধন-ঝুঁকি অনুপাত কমে গিয়ে ৩.১ শতাংশে নেমে এসেছে, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত সীমানার অনেক নিচে। এ সময়, অনাদায়ী ঋণের বিপরীতে সংরক্ষণ কমে দাঁড়িয়ে থাকে ২৫ শতাংশে।
মুডিস জানিয়েছে, তারা যে তিনটি ব্যাংকের ঋণমান নির্ধারণ করেছে, সেই ব্যাংকগুলো হলো ইস্টার্ন ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক এবং সিটি ব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, ঋণগ্রহীতাদের চাপ কমানোর জন্য ন্যূনতম সুদের হার থেকে কম সুদে ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যা খাতে আর্থিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে সহায়ক হবে। তবে মাত্র ২ শতাংশ অগ্রিম অর্থ জমা দেয়ার সীমা কিছু ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের ৩০ জুনের হিসাব অনুযায়ী, বিদ্যমান খেলাপি ঋণের জন্য ব্যাংক ও গ্রাহকের সম্পর্ক অনুযায়ী কমপক্ষে ২ শতাংশ নগদ অর্থ জমা দিতে হবে। এই অর্থ জমা করার পর, কোন ঋণ নিয়মিত হয়, তা নিশ্চিত করতে দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ (ঋণ পরিশোধে বিরতি) মোট দশ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়া হবে। আর যদি একই ঋণ তিন বা ততোধিকবার পুনঃতফসিলের আওতায় আসে, তবে অতিরিক্ত ১ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে। এছাড়া, পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের নির্ধারিত ঋণ পরিশোধের সূচি অনুযায়ী তিন মাস বা এক ত্রৈমাসিক কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ওই ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, আগে যে অর্থ জমা দেওয়া হয়েছিল, সেটি এই ২ শতাংশ হিসেবে গণ্য হবে না। নতুন করে জমা দেওয়া অর্থ নগদায়িত হলে, ছয় মাসের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দিয়েছে, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ঋণগ্রহীতাদের ক্ষতির পরিমাণ এবং প্রতিষ্ঠানের পুনরুদ্ধার সম্ভাবনাকে বিবেচনা করে ঋণ পুনঃতফসিল করতে হবে। সেই সঙ্গে, এই সুবিধা দিয়ে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে ব্যাংক ও গ্রাহকের সাক্ষামত বা সোলেনামার মাধ্যমে, চলমান মামলার কার্যক্রম স্থগিতের ব্যবস্থা নিতে হবে।
উল্লেখ্য, দেশের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ গত জুনে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৭.০৯ শতাংশ। এক বছরে এই ঋণ বেড়েছে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি, যা অর্থনীতির জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছে অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা।