বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিরুদ্ধে গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের উচ্চ আদালতের নির্দেশে বোর্ড গঠন করা হয়। তবে সেই বোর্ড ‘করণীয়’ ও ‘গ্রাহকের পাওনা ফিরিয়ে দেওয়া’র বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনও সুরাহা করতে পারেনি। এমনকি বোর্ড সদস্যরা এমনও বলেছেন, ‘এখন ইভ্যালি ছাড়তে পারলেই তারা বাঁচেন’। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই ‘ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড’ পরিচালনার জন্য আরেকটি বোর্ড গঠনের নির্দেশনা দিয়েছে উচ্চ আদালত। প্রশ্ন উঠেছে, ‘ইভ্যালির এই অবস্থার মধ্যে নতুন করে ডেসটিনি পরিচালনায় গঠিত বোর্ড কি সফল হবে? ক্ষতিগ্রস্তরা কি তাদের টাকা ফেরত পাবেন?’
ইভ্যালির সংকট উত্তরণে গত বছরের ১২ অক্টোবর বোর্ড গঠনের নির্দেশনা দেয় উচ্চ আদালত। বোর্ড চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এ ছাড়া পর্ষদ সদস্য আছেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব মো. রেজাউল আহসান, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে আছেন ফখরুদ্দিন আহমেদ ও আইনজীবী হিসেবে খান মোহাম্মদ শামীম আজিজ। আর সরকারি বেতনে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির।
এই বোর্ড গত ১১ মাসে চারটি বৈঠক ও দুটি সিন্দুক বা লকার ভাঙা ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারেনি। এই দুই লকারে দৈনিক পত্রিকার কিছু কাটিং ও ফেসবুক আইডির নাম ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। ইভ্যালির জন্য গঠিত বোর্ড সার্ভারের পাসওয়ার্ডও উদ্ধার করতে পারেননি। এমনকি অর্থের অভাবে নিয়মিত বৈঠক ও দাফতরিক কাজও করতে পারেননি তারা।
বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী সপ্তাহেই তাদের কেউ কেউ এই বোর্ড থেকে পদত্যাগ করতে পারেন। সংবাদ সম্মেলন করে তারা পদত্যাগ করবেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
ভুক্তভোগীদের টাকা ফেরত দেওয়ার বিষয়ে বোর্ড আন্তরিক থাকলেও গেটওয়ে থেকেও তারা টাকা উত্তোলন করতে পারেননি। এ বিষয়ে বোর্ড চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা কাজ করার জন্যই এসেছিলাম। তবে বিভিন্ন কারণে কাজ করা যায়নি। আমরা আগামী সপ্তাহে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানিয়ে দেবো।’
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এবং আর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন। অস্বাভাবিক মূল্য ছাড়ে পণ্য বিক্রি করে তারা আলোচনায় আসেন। ২০২১ সালে ২১ সেপ্টেম্বর গ্রাহকদের করা মামলায় র্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হন তারা। তাদের বিরুদ্ধে অন্তত ৩০টি মামলা রয়েছে। চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন জামিন পেলেও কারাগারে রয়েছেন মোহাম্মদ রাসেল।
ইভ্যালির এই পরিস্থিতি মধ্যেই ডেসটিনির আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তবে এই বোর্ড কতটা সফল হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। খোদ ইভ্যালি পরিচালনায় গঠিত বোর্ডের এক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে বলেছেন, ‘এই প্রক্রিয়াগুলো জটিল। আমরাই (ইভ্যালির বোর্ড) পারছি না, ডেসটিনির বোর্ড কতটুকু পারবে আমার জানা নেই।’
তিনি যুক্তি তুলে ধরে বলেন, ‘যারা আগে থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলো চালিয়েছেন তারাই এগুলোর খুঁটিনাটি সব জানেন। তারা যদি সহযোগিতা না করেন, তাহলে হুট করে বাইরে থেকে এসে প্রতিষ্ঠানগুলো পুনরায় চালু করা এবং পাওনাদারদের অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা কঠিন।’
এ বিষয়ে ডেসটিনির আইনজীবী ব্যারিস্টার মইনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাইকোর্ট আমাদের দরখাস্ত মঞ্জুর করেছেন। ফলে ডেসটিনি নিয়ে যে অচলাবস্থা ছিল তা দূর হয়েছে। যারা আদালতের রায়ে দণ্ডিত হননি এবং কোর্ট যাদের পরিচালনা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছিলেন তাদের সমন্বয়ে কোম্পানি পরিচালিত হবে। শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় এই বোর্ড যেকোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। হাইকোর্টের আদেশের মাধ্যমে আগের বোর্ডকে পুনর্গঠন করায় তারা কোম্পানিটি চালু করতে পারবেন।
ডেসটিনির আইনজীবী আরও বলেন, ‘ডেসটিনির যারা দোষী ছিলেন, তাদের শাস্তি হয়েছে বা হবে। কিন্তু কোম্পানি তো আছে, সেটা বন্ধ হলে কেউ লাভবান হবেন না। আমরা চাইছি, যারা পুরোনো বোর্ডে ছিলেন তাদের কয়েকজন এবং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বাইরে থেকে কয়েকজন নিয়ে বোর্ড গঠন করা হলে কার্যক্রম শুরু হবে। এতে অচলাবস্থাও কেটে যাবে। তা না হলে সম্পত্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বেদখল হচ্ছে, তখন কেউ কিছু পাবে না। গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
ইভ্যালির আগের বোর্ডের সদস্যরা বর্তমান বোর্ডকে তেমন সহযোগিতা করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ডেসটিনির ক্ষেত্রেও তেমনটা হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এখানে এমন হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, যারা এর উদ্যোক্তা তারা বোর্ডে না থাকলেও কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার। তারা চাইবেন না কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তারাও চাইছেন প্রতিষ্ঠানটি চলুক।’
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা দুদকের দুই মামলার তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ৫ মে সংস্থাটি আদালতে উভয় মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এরমধ্যে ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মামলায় ৪৬ জন এবং ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন লিমিটেডের দুর্নীতির মামলার ১৯ জনকে আসামি করা হয়। সাবেক সেনাপ্রধান হারুন-অর-রশিদ ও রফিকুল আমিন দুই মামলাতেই আসামি।
গত ১২ মে বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়ে ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীনকে ১২ বছর কারাদণ্ড এবং ২০০ কোটি টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৩ বছরের সাজা দেওয়া হয়। রফিকুল আমিনসহ মামলার ৪৬ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং তাদের মোট ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এরমধ্যে আসামি হারুন-অর-রশীদকে দেওয়া হয় চার বছরের কারাদণ্ড। সেই সঙ্গে তাকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে ছয় মাস কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘উচ্চ আদালত ক্ষতিগ্রস্ত অসংখ্য মানুষের কথা ভেবেই হয়তো বোর্ড গঠন করে দিয়েছে। কারণ, ডেসটিনিতে হাজার হাজার মানুষের টাকা পয়সা পড়ে আছে। যারা এটির দায়িত্বে ছিল, তারা অপরাধী হিসেবে ইতোমধ্যে শাস্তি ভোগ করছে। তাদের ডেসটিনির ধারেকাছে আর ভিড়তে দেওয়া যাবে না। আমি মনে করি এই বোর্ডের প্রথম কাজ হওয়া উচিত ক্ষতিগ্রস্তদের পয়সা ফিরিয়ে দেওয়া। কোথাও যদি বোর্ড আটকে যায়, তাহলে সেটা উচ্চ আদালতকে জানানো উচিত।’